বিশ্বমানব
শিক্ষায় পবিত্র কুরআনের আলো। [ সুরা—৫ মায়িদাহ—২১ থেকে ৩০ আয়াত।]
২১) হে আমার
সম্প্রদায়! আল্লাহ্ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি নির্দিষ্ট করেছেন তাতে তোমরা
প্রবেশ কর এবং পশ্চাদপদসরণ করো না, করলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।
মর্মার্থঃ—মানব
সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহ্ পৃথিবীস্বরূপ মানবদেহ বা পবিত্র ভূমি নির্দিষ্ট করে
দিয়েছেন। সেই পবিত্র ক্ষেত্র বা ভূমিতে প্রবেশ করে মানুষকে সেই জমি চাষ করে ফসল
ফলাতে হয়। যারা এই ভূমিতে প্রবেশ করার কৌশল না জানার জন্য ভয়ে পিছিয়ে পড়ে তারাই
ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবদিক থেকে। শান্তচিত্তে মৃতভূমিকে জীবন্তভূমিতে পরিণত করতে না
পারলে ও সেই ভূমিতে শান্তির বীজ বপন না করতে পারলে সবই আগুনে ভস্মীভূত হবে।
২২)
তারা বলল, হে মূসা! সেখানে এক দুর্দান্ত সম্প্রদায় রয়েছে এবং তারা সেই স্থান হতে
বের না হওয়া পর্যন্ত আমরা সেখানে প্রবেশ করবই না। তারা সেই স্থান হতে বের হয়ে গেলে
আমরা প্রবেশ করব।
মর্মার্থঃ—মানব
দেহভূমির অন্তর জুড়ে কাম- ক্রোধ- লোভ- মোহ- মদ ও মাৎসর্য যুক্ত এক দুর্দান্ত
সম্প্রদায় বাস করে। তারা যতক্ষণ এই দেহভূমি দখল করে থাকে ততক্ষণ কেউ মূসার কথা মতো
পবিত্র হয়ে সেই ভূমিতে প্রবেশ করে শান্তির বীজ বপন করতে সক্ষম হবে না। তাই তারা
কেউ সেখানে প্রবেশ করতে রাজী হল না।
২৩)
তাদের মধ্যে দুজন যারা ভয় করেছিল, তাদের প্রতি আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছিলেন, তারা
বলল, তোমরা প্রবেশদ্বারে তাদের মুকাবিলা কর, প্রবেশ করলেই তোমরা জয়ী হবে, আর তোমরা
বিশ্বাসী হয়ে আল্লাহ্র উপরই নির্ভর কর।
মর্মার্থঃ—মানুষের অন্তর ভূমিতে যে বিবেক ও চিত্ত রয়েছে তারাও এই
সম্প্রদায়কে ভয় করেছিল কিন্তু আল্লাহ্ তাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। তারাই মানুষকে
সেই ভূমিতে প্রবেশ করার সাহস দিয়ে থাকে। সেখানে একবার সাহসভরে প্রবেশদ্বারে গিয়ে
মুকাবিলা করতে পারলেই মানুষ জয়ী হবে। মানুষ যত বিশ্বাসী হয়ে আল্লাহ্র উপর
নির্ভরশীল হবে ততই এই ভূমিতে শান্তির বীজ বপন করার জন্য ভূমিকে দখলমুক্ত অবস্থায়
পাবে।
২৪) তারা
বলল, হে মূসা! তারা যতদিন সেখানে থাকবে ততদিন আমরা সেখানে প্রবেশ করবই না, সুতরাং
তুমি ও তোমার প্রতিপালক যাও এবং জেহাদ কর, আমরা এখানেই বসে থাকব।
মর্মার্থঃ—নিজের
ভূমি যদি একবার শত্রু দখল করে নেয় তবে সেই ভূমি দখল মুক্ত করে তোলা যে বড়ই কঠিন তা
এখানে সকলেই এক কথায় স্বীকার করে নিয়েছে মূসার কাছে। তাই তারা কেউ জেহাদে অংশ
গ্রহণ করতে রাজী হল না, তারা যে অবস্থায় রয়েছে সেই অবস্থাতেই বসে থাকতে চাইল।
২৫) সে
বলল, হে আমার প্রতিপালক আমার ও আমার ভ্রাতা ব্যতীত অন্য কারও উপর আমার আধিপত্য
নেই, সুতরাং তুমি আমাদের ও সত্যত্যাগী সম্প্রদায়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও।
মর্মার্থঃ—মূসা
জ্ঞানী আত্মা। সে জানত তার আধিপত্য কেবল নিজের উপর এবং নিজের শক্তির উপর কার্যকরী,
অন্যের উপর তার আধিপত্য বিস্তার করা মানে চোরাবালির উপর ইমারৎ বানানো, যা মিথ্যা
অহংকার মাত্র। তাই সে বলল, হে আমার
প্রতিপালক আমার ও আমার ভ্রাতা ( আমার শক্তি ও জ্ঞান) ব্যতীত অন্য কারও উপর আমার
আধিপত্য নেই, সুতরাং তুমি আমাদের ও সত্যত্যাগী সম্প্রদায়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও।
আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও এই মীমাংসা করার ক্ষমতা নেই।
২৬)
আল্লাহ্ বললেন, তবে এটা চল্লিশ বছর তাদের জন্য নিষিদ্ধ রইল, তারা পৃথিবীতে
উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবে, সুতরাং তুমি সত্যত্যাগী সম্প্রদায়ের জন্য দুঃখ করো
না।
মর্মার্থঃ—আল্লাহ্র চল্লিশ বছর মানে পৃথিবীর কয়েক হাজার বছর, মানুষ নিজের
জীবন সত্যকে না জেনে অভিশপ্ত অবস্থায় পৃথিবীতে উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবে। সুতরাং
সত্যত্যাগী সম্প্রদায়ের জন্য দুঃখ করে কোন লাভ হবে না।
২৭) আদমের দুই পুত্রের ( হাবিল ও কাবিল)
বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শোনাও, যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল তখন একজনের
কুরবানী কবুল হল এবং অন্য জনের কুরবানী কবুল হল না। তাদের একজন বলল, আমি তোমাকে
হত্যা করবই। অপরজন বলল, আল্লাহ্ সংযমীদের কুরবানী কবুল করেন।
মর্মার্থঃ—যারা আল্লাহ্তেই নিজেদের চিত্ত
সমর্পণ করেছে, তাদের বাসনার নিবৃত্তি ঘটছে, আর তাদের কোন কাজেই প্রবৃত্তি নেই।
আদমের দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল। একজন প্রবৃত্তি মার্গের অপরজন নিবৃত্তি মার্গের
লোক। যাদের চিত্ত আল্লাহ্তে স্থির হয় নি, তাদের অন্তঃকরণও পবিত্র হয় নি। যাদের অন্তঃকরণ পবিত্র নয়, যারা
সংযমীচিত্তের অধিকারী হতে পারে নি, আল্লাহ্ কিভাবে তাদের কুরবানী কবুল করবেন? সে
যত বড় বংশ মর্যাদার লোক হোক না কেন।
২৮) আমাকে হত্যা করার জন্য তুমি হাত তুললেও
তোমাকে হত্যা করার জন্য আমি হাত তুলবো না, আমি তো বিশ্বজগতের প্রতিপালককে ভয় করি।
মর্মার্থঃ—যারা
সংযমী ও বিশ্বাসী তাদেরকে কেউ হত্যা করার জন্য হাত তুললেও তারা তাকে হত্যা করার বা
বাধা দেওয়ার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করে না। তারা এক বিশ্বজগতের প্রতিপালককে ছাড়া কাউকে
যেমন ভয় করে না, তেমনি তারা জানে জন্ম- মৃত্যু এগুলো একটা বিকার মাত্র, এগুলো
আল্লাহ্ই নিয়ন্ত্রণ করেন।
২৯) তুমি আমার ও তোমার পাপের ভার বহন কর এবং
জাহান্নামবাসী হও, এই তো আমি চাই এবং এটা জালিমদের (অনাচারী) কর্মফল।
মর্মার্থঃ—যে হত্যাকারী হবে তাকে দুই দিক থেকে পাপের ভার বহন করতে হবে। নিজের
পাপের সাথে সাথে যাদের সে হত্যা করবে তাদেরকে সে পাপ মুক্ত করে তাদের পাপের ভার
সাথে সাথে লাভ করবে। জালিমদের এটাই কর্মফল।
৩০) অতঃপর তার চিত্ত ভ্রাতৃ হত্যায় তাকে
উত্তেজিত করল এবং সে (কাবিল) তাকে (হাবিলকে) হত্যা করল, ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের
অন্তর্ভুক্ত হল।
মর্মার্থঃ—আদম
পুত্র, কাবিলের চিত্ত ছিল অস্থির, অন্তঃকরণ ছিল অপবিত্র। তাই সে নিজের জ্ঞান
হারিয়ে হাবিলকে অর্থাৎ তার ভাইকে হত্যা করল। এর ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত
হল।
জয় বিশ্বমানব
শিক্ষা ও পবিত্র কুরআনের আলোর জয়।
No comments:
Post a Comment