বিশ্বমানব শিক্ষায় পবিত্র কুরআনের আলো। [ সুরা—৩ আলে—ইমরান—৯৬ থেকে ১০০
আয়াত।]
৯৬) নিশ্চয় মানবজাতির জন্য সর্ব প্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা তো
বাক্কায় (মক্কায়), সেটা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী।
মর্মার্থঃ---মানবজাতিও একদা ফিরিশতাদের ন্যায় অদৃশ্য শক্তি হয়ে আল্লাহ্র
রাজত্বের মধ্যেই ছিল, কিন্তু তাদের কোন গৃহ ছিল না, বাসভূমি ছিল না। আল্লাহ্ মহান
এই মানবজাতির প্রতি কৃপা করেন। তিনিই বাক্কায় অর্থাৎ এই পৃথিবীতে সর্ব প্রথম মানুষকে পৃথিবীস্বরূপ দেহদান করেন
এবং সেই দেহকে বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী করে গড়ে তোলেন। মানবজাতির এই দেহে আকাশ
ও পৃথিবীর সবকিছু জুড়ে দিয়ে তিনি জ্ঞান- বিজ্ঞান দান করলেন এবং এই দেহকেই পুণ্য
হজে পরিণত করলেন এবং এক সত্য স্তম্ভ নাভিমূলে স্থাপন করলেন এবং সেই সত্য স্তম্ভে
মনকে স্থিরভাবে দাঁড় করিয়ে তাঁকে নিজ হৃদয়ে দেখতে বললেন এবং তাঁর সাথে যোগসূত্র
স্থাপন করে সত্যমুখী হয়ে চলতে নির্দেশ দিলেন।
৯৭) ওতে বহু সুস্পষ্ট নিদর্শন
রয়েছে, (যেমন) ইব্রাহীমের (আঃ) দাঁড়াবার স্থান। যে কেউ সেখানে প্রবেশ করে সে
নিরাপদ। মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে ঐ
গৃহের হজ করা তার (পক্ষে) অবশ্য কর্তব্য। এবং যে অস্বীকার করবে সে জেনে রাখুক,
আল্লাহ্ জগতের উপর নির্ভরশীল নন।
মর্মার্থঃ—আল্লাহ্ জগতের উপর নির্ভরশীল নন, যদিও তিনি এই জগতের স্রষ্টা।
মানুষকে তিনি নিজের মন থেকে সৃষ্টি করেন এই মাটিতে, মানবাত্মার উন্নতির জন্যে।
মানবাত্মার উন্নতির জন্যেই তিনি জ্ঞান- বিজ্ঞানময় পৃথিবীস্বরূপ দেহ দান করেন এবং
নিজের জ্ঞান- বিজ্ঞানের দ্বারা সত্যকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এগিয়ে যাবার নির্দেশ
দেন। মানব দেহই হচ্ছে আল্লাহ্র সত্য নিদর্শন, ইব্রাহীমের (আঃ ) ন্যায় কত নবী রসূল
মহানেরা সত্য স্তম্ভে দাঁড়িয়ে সত্যকে অর্থাৎ নিজ স্রষ্টাকে দর্শন করেছেন।
স্রষ্টাকে দর্শন করায় হচ্ছে হজ। এইভাবে বিশ্ববোধে জাগ্রত হয়ে সত্য স্তম্ভে দাঁড়িয়ে
স্রষ্টাকে দর্শন করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু যার সামর্থ্য আছে তার অবশ্যই
কর্তব্য হজ করে স্রষ্টাকে দর্শন করে জীবন ধন্য করা। মানুষের জন্য স্রষ্টার এই গৃহই হচ্ছে নিরাপদ
স্থান। এখন এই সত্যকে জানার পরেও যদি কেউ অস্বীকার করে, তবে নিশ্চয় তার জেনে রাখা উচিত, তার স্রষ্টা এই বিশ্বজগতের উপর নির্ভরশীল
নন।
৯৮) বল, হে আসমানী গ্রন্থধারীগণ! কেন
তোমরা আল্লাহ্র নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার কর? যখন তোমরা যা কর আল্লাহ্ তার সাক্ষী।
মর্মার্থঃ--- এ জগতে মানবজাতি আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠ নিদর্শন তা আসমানী
গ্রন্থধারীগণ বা ধার্মিক জ্ঞানীরা সকলেই জানে এবং তারা তা কখনো অস্বীকার করে না।
তাই তারা মানবজাতির উন্নতির জন্যে আল্লাহ্র দেওয়া জ্ঞান- বিজ্ঞানকে শুভ কাজে
লাগিয়ে এই পৃথিবীকে মানব জাতির শিশুর উপযুক্ত বাসভূমি গড়ে তোলার কাজে জীবন উৎসর্গ
করে। এই মহান মানুষের দ্বারা নির্মিত সকল স্তম্ভই সত্যজ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানব সন্তানদের অন্তরে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য। যা কিছু সুন্দর
এই বিশ্বের বুকে তাই আল্লাহ্র জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাক্ষী বহন করে, মানুষের অন্তরে
বিশ্বাস স্থাপন করে আলোকিত করার জন্য।
৯৯) বল, হে আসমানী গ্রন্থধারীগণ!
যখন তোমরাই সাক্ষী তখন যারা বিশ্বাস করেছে, আল্লাহ্র পথকে বাঁকা করার উদ্দেশ্যে
তাদেরকে কেন তা থেকে ফিরিয়ে দাও? আর তোমরা যা কর আল্লাহ্ সে সম্বন্ধে অনবহিত নন।
মর্মার্থঃ—যারা ঐশী কিতাবের আশ্রয়ে থেকে
এই বিশ্বকে মানব জাতির কর্মভূমি ও জ্ঞানপীঠ রূপে বিশ্বাস করেছে উদার মনোভাব নিয়ে,
তাদের কাছে স্রষ্টার সমস্ত সৃষ্টিই নিদর্শন হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই এদের কাছে সকলেই
প্রিয় ও মহান। এরা কখনও আল্লাহ্র পথ থেকে কাউকে ফিরিয়ে দেয় না, সকলকে সাথে নিয়ে
তাঁর আলোর পথে এগিয়ে যায়, কখনো নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করার সময় পায় না। আর
যারা নিজের ও নিজ পরিবারের স্বার্থের মধ্যেই আবদ্ধ থাকে তারা আল্লাহ্র দেওয়া
জ্ঞান- বুদ্ধি- বিবেককে সংকীর্ণ করতে করতে এতই সংকীর্ণ করে ফেলে যে সেই বাঁকা পথে
আর আলো প্রবেশ করতে পারে না, তখন সেই পথ থেকে সবায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়। আল্লাহ্
এই সব ঐশী গ্রন্থধারীদের সমস্ত কার্যকলাপ দেখেন এবং তাদেরকে আরও ক্ষুদ্র সংসারের
অন্ধকারে আবদ্ধ করে ফেলেন।
১০০) হে বিশ্বাসীগণ! যাদের কিতাব দেয়া হয়েছে তোমরা যদি তাদের দল বিশেষের
আনুগত্য কর তবে তারা তোমাদের বিশ্বাসের পর আবার অস্বীকারকারীদের দলভুক্ত করবে।
মর্মার্থঃ--- এই পৃথিবীর বুকে কত ঐশী কিতাব বা ধর্মগ্রন্থ আছে তার হিসেব
নেই এবং কতজনকে ঐ পবিত্র কিতাব বা ধর্ম গ্রন্থ দেওয়া হয়েছে তাঁদের প্রতিপালকের তরফ
থেকে তারও হিসেব মানুষের কাছে নেই। দেখা গেছে যারাই এই কিতাব বা ধর্মগ্রন্থ পেয়েছে
তারাই একটা আলাদা ধর্মের দল করে বসেছে এই পৃথিবীর বুকে। ফলস্বরূপ মানুষের মনে এক
পরমাত্মার প্রতি বিশ্বাসের পরিবর্তে অবিশ্বাস দানা বাঁধতে শুরু করেছে এবং এক
ধর্মদলের লোক অপর ধর্ম দলের লোকের ঈশ্বরকে অস্বীকার করছে প্রকাশ্যে অন্তর ও বাইরে
থেকে। এর ফলে মানবজাতির অধঃপতন হচ্ছে এবং তারা ধার্মিকের পরিবর্তে অধার্মিক ও
ধর্মহীন নাস্তিক জাতিতে পরিণত হচ্ছে। কেউই তাদের জীবন সত্যকে জানতে পারছে না
সংকীর্ণ ধর্মের গণ্ডীতে আবদ্ধ হয়ে। তাই তারা নাস্তিক হয়ে নিজের ধর্ম ও নিজের স্রষ্টাকেই
অস্বীকার করছে এবং মানব জাতিকে পথভ্রষ্ট করছে।
জয় বিশ্বমানব শিক্ষা ও পবিত্র কুরআনের আলোর জয়।
No comments:
Post a Comment