Monday, 23 July 2018

কুরআন সুরা--৩ আলে-- ইমরান --২৬ থেকে ৩০ আয়াত

   বিশ্বমানব শিক্ষায় পবিত্র কুরআনের আলো। [ সুরা—৩ আলে- ইমরান—২৬ থেকে ৩০ আয়াত।]
   ২৬) বল, হে সার্বভৌম শক্তির মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর, এবং যার থেকে ইচ্ছা রাজ্য কেড়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মানিত কর, আর যাকে ইচ্ছা অপমানিত কর। (যাবতীয়) কল্যাণ তোমার হাতেই। নিশ্চয় তুমি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান।
       মর্মার্থঃ—প্রত্যেকের আল্লাহ্‌ অন্তর্যামী ও সবার সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান। তিনি সবার অন্তরের কথা জানেন, কে কি চাইছে এবং সেই চাওয়ার মধ্যে কল্যাণ নিহিত আছে কিনা, বিচার করেই তিনি তাঁর শক্তি প্রয়োগ করেন। তিনি সার্বভৌম শক্তির মালিক হয়েও নিজের হাতে কোন ক্ষমতা রাখেন না,সব ক্ষমতা তিনি সবার মধ্যে ভাগ করে দিয়ে, শূন্য হাতেই কেবল নিজের ইচ্ছা কল্যাণের দিকে প্রয়োগ করেন, তাতেই কেউ রাজা হয়, কেউ ফকির হয়, কেউ সম্মানিত হয়, আবার কেউ অপমানিত হয়, এই রঙ্গমঞ্চে। তাঁর দূরদর্শিতা আর মানুষের দূরদর্শিতার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। এই রঙ্গমঞ্চে রাজা- ফকির- মান- অপমান সবকিছুই ক্ষণিকের অভিনয় মাত্র, মানুষকে পবিত্র করে এই মৃত্যুলোক থেকে তুলে নেওয়ার জন্য।
      ২৭) তুমি রাতকে দিনে, দিনকে রাতে পরিবর্তন কর, এবং তুমিই মৃত হতে জীবন্তের আবির্ভাব ঘটাও, আবার জীবন্ত থেকে মৃতের আবির্ভাব ঘটাও। তুমি যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবনোপকরণ দান কর।
      মর্মার্থঃ—এই মৃত্যুলোকে প্রত্যেক জীবের একটা নির্দিষ্ট আয়ুর রেখা আছে। এই আয়ুকে কেন্দ্র করেই দিন রাতের পরিবর্তন ঘটে সময়কে মান্য করে বিধান অনুসারে। এই লোকেই চলে জন্ম মৃত্যুর লীলা খেলা। জীবের জন্ম হচ্ছে মৃতদের মধ্যে থেকে আবার জীব মৃতদের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে কর্ম শেষে। এই যে জীবের  জন্ম- মৃত্যুর রহস্য এ তিনি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ জানে না, তাঁরই নির্দেশে এই লীলা খেলা চলছে অনাদিকাল ধরে। তিনিই জীবের জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। আবার দেখা যাচ্ছে তিনি যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবনোপরণ দান করছেন, তাঁর পরীক্ষা নেওয়ার পদ্ধতি যে কতভাবে কাজ করে, জীবের উন্নয়নের জন্য তা সাধারণ মানুষের জ্ঞান- বুদ্ধিতে আসবে না। তাই তাঁর বাক্যকে বিশ্বাস করে পরবর্তী জীবনকে সুন্দর করে লাভ করার জন্যই প্রস্তুতি নেওয়ায় হচ্ছে এই জীবনের লক্ষ্য।
      ২৮) বিশ্বাসীগণ যেন বিশ্বাসীদের ছাড়া অবিশ্বাসীদের অভিভাবক রূপে গ্রহণ না করে। যে কেউ এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহ্‌র কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে ব্যতিক্রম, যদি তোমরা তাদের কাছ থেকে কোন আশংকা কর তাহলে তোমরা তাদের ব্যাপারে সাবধানে থাকবে। আর আল্লাহ্‌ তাঁর নিজের সম্বন্ধে তোমাদেরকে সাবধান করছেন। এবং আল্লাহ্‌র দিকেই প্রত্যাবর্তন।
     মর্মার্থঃ—আল্লাহ্‌ ছাড়া দ্বিতীয় কেউ অভিভাবক নেই, এই সত্য সকলে  পূর্বেই জেনেছেএবার এই আয়াতে মানুষকে সজাগ করে দিয়ে বলা হলো,  আল্লাহ্‌ মানুষের অন্তরের থাকেন, তাই বিশ্বাসীরা যেন বিশ্বাসীদেরকেই অভিভাবক করে, অবিশ্বাসীদেরকে যেনো তারা অভিভাবক না করে। প্রয়োজনে অবিশ্বাসীদের অভিভাবক রূপে গ্রহণ করলেও তাদের ব্যাপারে সাবধানে থাকবে, যেনো তাদের জীবনের অজ্ঞতা- অন্ধকার তোমাদের ছেয়ে না ফেলে। এই আয়াতে-- আল্লাহ্‌ অন্তরে থেকে তাঁর নিজের সম্বন্ধেই তোমাদেরকে সাবধান করছেন, কারণ তিনি তোমাদেকে তাঁর দিকেই ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে তোমাদের অন্তরে থেকে আলো দান করে চলেছেন। 
      ২৯) বল, তোমাদের মনে যা আছে তা যদি তোমরা গোপন রাখ, কিংবা প্রকাশ কর, আল্লাহ্‌ তা অবগত আছেন, এবং আকাশে ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তাও অবগত আছেন এবং আল্লাহ্‌ সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান।
    মর্মার্থঃ—আল্লাহ্‌ এমন এক শক্তির স্রোত যা সর্বব্যাপী প্রবাহিত, তিনি মানুষের মনে অবস্থান করেন এবং মনের অবস্থার কথা জানেন। তাই তাঁর কাছে কিছুই গোপন থাকে না। আকাশে ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তাও তিনি অবগত আছেন, তাই তিনি মানুষের মনকে আকাশ ও পৃথিবীর সাথে যুক্ত করে দিয়ে নিজের সৃষ্টিলীলা অনাদিকাল থেকে চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান হয়ে মানুষের মন, বুদ্ধি ও চিত্তকে তাঁর কর্মের সাথী করে নেন কিন্তু মায়ায় আবদ্ধ অবিশ্বাসীরা এই তত্ত্বজ্ঞানে বিশ্বাস করে না, তারা ভাবে মানব দেহ ভাল- মন্দ কাজের সাথে যুক্ত এবং এই দেহই শাস্তি ও পুরষ্কার পায় কর্মগুণে। তারা নিজের অদৃশ্য শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দৈবসম্পদ সঞ্চয় করে পরকালের জীবন তৈরি করার প্রতি আগ্রহ দেখায় না।
    ৩০) যে দিন প্রত্যেকে সে যে ভাল কাজ করেছে এবং সে যে মন্দ কাজ করেছে তা বিদ্যমান পাবে, সেদিন সে কামনা করবে, তার ও ওর ( কর্মফলের) মধ্যে বহু দূর ব্যবধান। বস্তুত আল্লাহ্‌ তাঁর নিজের সম্বন্ধে তোমাদেরকে সাবধান করছেন। আর আল্লাহ্‌ বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত অনুগ্রহশীল।
   মর্মার্থঃ—দেহ বিনাশের পর আবার নব দেহ গঠনের প্রক্রিয়া সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় জ্ঞান ও বিশ্বাসের মাত্রা অনুসারে। তখন সমস্ত খাদ ( পার্থিব জগতের জ্ঞান ও সম্পদ) সোনা থেকে বাদ দিয়ে খাটি সোনা( দৈবসম্পদ)  টুকুই গ্রহণ করা হয় দেহের আকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে। এখানে তো কেউ কারো কাছে ধার- দেনা করে নব জীবনের কাঠামো তৈরি করার জন্য সুপারিশ করতে পারবে না। যে যেমন উপার্জন করে নিয়ে এসেছে নিজের অবয়ব তৈরী করার জন্য সে সেই টুকুই পাবে এবং তা দিয়েই তৈরি হবে তার নব জীবনের আকৃতি। এই কারখানায় এসে তখন সবায় আফসোস করে নিজের কৃতকর্মের জন্য। এখানে সকলেই দেখতে পাবে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে কত ব্যবধান নব জীবন পাওয়ার ক্ষেত্রে। কারো উপর এখানে অবিচার করা হচ্ছে না, সবায় নিজ নিজ কর্মফল অনুসারে পুনঃ কাজ করার অধিকার পেয়ে যাচ্ছে নব জীবন লাভ করে। কারো অধিকার খর্ব করা হচ্ছে না, কেউ স্বর্গীয় দ্বীপ্তিতে পূর্ণ জীবন লাভ করছে, আবার কেউ নরকের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরার জন্য সোনা বিহীন জীবন লাভ করছে। এই নব জীবন দেওয়ার জন্যে ও পাওয়ার জন্য মানুষের অন্তরে তার আল্লাহ্‌ ( পবিত্র জ্ঞানময় সত্তা) তাকে সাবধান করেছেন কতভাবে, তবুও মানুষ তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয়নি এবং নিজেকে পবিত্র জ্ঞানী সত্তা রূপে গড়ে তোলার সাধনা করেনি। আল্লাহ্‌ প্রকৃত পক্ষে তাঁর বান্দাদের খুব ভালবাসেন এবং তাদেরকে খাঁটি সোনা করেই তুলে নিতে চান। এমন প্রজ্ঞাময়, অনুগ্রহশীল, পরম দয়ালু, অভাবমুক্ত আল্লাহ্‌কে হৃদয় রাজত্বে ধরে রেখেও মানুষ অন্ধ, নিঃস্ব হয়ে ফিরে যায় সেই কারখানায় নব জীবন লাভ করার জন্য, এর থেকে দুর্ভাগ্য আর কি থাকতে পারে?
     জয় বিশ্বমানব শিক্ষা ও পবিত্র কুরআনের আলোর জয় ।

No comments:

Post a Comment