পবিত্র গীতার
যুদ্ধ ধর্ম্ম যুদ্ধ—অধর্ম্মকে বিনাশ করে ধর্ম্মের প্রতিষ্ঠার জন্য। প্রত্যেক যুগেই মানুষ জীবনের সত্যকে না জানার
ফলে অধর্ম্মকেই ধর্ম্ম এবং ধর্ম্মকে অধর্ম্ম রূপে প্রচারের আলোতে নিয়ে এসে মানুষকে
পথভ্রষ্ট করে। যখন পথভ্রষ্ট মানুষের
সংখ্যা বেড়ে যায় তখনি সমাজ- সংসার- রাষ্ট্রে প্রতি পদে পদে বিপর্যয় দেখা যায়। এই
বিপর্যয় রোধ করে সত্যকে ধর্ম্মের অঙ্গনে প্রতিষ্ঠার জন্যই গীতার নিত্য যুদ্ধ। আজকে
অর্জ্জুন- বিষাদযোগের—১২ থেকে ২০ শ্লোক পাঠ শুরু করছি।
ধর্মযুদ্ধ শুরু
হবার প্রারম্ভে সবার অন্তর থেকে জয়- পরাজয়ের দুঃখ – গ্লানি দূর করার জন্য এবং
সকলের অন্তরে আনন্দ উৎপন্ন করার জন্য কুরুকুলের প্রতাপশালী বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম
প্রথম উচ্চ সিংহনাদপূর্ব্বক শঙ্খধ্বনি করলেন। এই শঙ্খধ্বনি মানব সমাজে
মঙ্গলসুচক শুভবার্তা বহন করে, সেই সাথে অন্তরের অশুভচিন্তার বিনাশ ঘটায়। তাই শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে ধর্মযুদ্ধ
শুরু হতে চলেছে কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে এই বার্তা আকাশে- বাতাসে- অন্তরীক্ষে
ও পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো। প্রথম
অধ্যায়ের ১২ থেকে ২০ শ্লোক পাঠ করলেই ধর্মযুদ্ধের আনন্দে মানুষের অন্তর থেকে সমস্ত
পাপ- তাপ- বিষাদ তৎক্ষণাৎ বিনাশ হয়ে যায়।
১২) তস্য সংজনয়ন
হর্ষং কুরুবৃদ্ধঃ পিতামহঃ। সিংহনাদং বিনদ্যোচ্চৈঃ শঙ্খং দধ্মৌ প্রতাপবান।।
অনুবাদঃ--তাঁর ( দুর্যোধনের) আনন্দ উৎপন্ন করে কুরুকুলের প্রতাপশালী বৃদ্ধ পিতামহ
ভীষ্ম উচ্চ সিংহনাদপূর্ব্বক শঙ্খধ্বনি করলেন।
১৩) ততঃ শঙ্খাশ্চ ভের্য্যশ্চ পণবানকগোমুখাঃ।
সহসৈবাভ্যহন্যন্ত স শবদস্তুমুলোহভতৎ।। অনুবাদঃ-অনন্তর অকস্মাৎ শঙ্খ, ভেরী, প্রণব,
গোমুখ প্রভৃতি বাদ্য বেজে উঠল। সেই শব্দ তুমুল হয়ে উঠল।
১৪)ততঃ
শ্বেতৈর্হয়ৈর্যুক্তে মহতি স্যন্দনে স্থিতৌ। মাধবঃ পাণ্ডবশ্চৈব দিব্যৌ শঙ্খৌ প্রদধমতুঃ।।
অনুবাদঃ—
তারপর শ্বেতাঙ্গ বিশাল রথে অবস্থিত শ্রীকৃষ্ণ ও
অর্জ্জুন দুইটি দিব্য শঙ্খ বাজালেন।
১৫) পাঞ্চজন্যং
হৃষীকেশো দেবদত্তং ধনঞ্জয়ঃ। পৌণ্ড্রং দধ্মৌ মহাশঙ্খং ভীমকর্ম্মা বৃকোদরঃ।
অনুবাদঃ-- শ্রীকৃষ্ণ পাঞ্চজন্য, অর্জ্জুন দেবদত্ত এবং ভীমকর্ম্মা ভীম পৌণ্ড্র নামক
মহাশঙ্খ বাজালেন।
১৬) অনন্তবিজয়ং
রাজা কুন্তিপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ। নকুলঃ সহদেবশ্চ সুঘোষ- মণিপুষ্পকৌঃ।। অনুবাদঃ--
কুন্তীপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির অনন্তবিজয় নামক শঙ্খ এবং নকুল ও সহদেব যথাক্রমে সুঘোষ
ও মণিপুষ্পক নামক শঙ্খ বাজালেন।
১৭—১৮) কাশ্যশ্চ পরমেষ্বাসঃ শিখণ্ডী চ মহারথঃ।
ধৃষ্টদ্যুম্নো বিরাটশ্চ সাত্যকিশ্চাপরাজিতঃ।। ১৭।। দ্রুপদো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব্বশঃ
পৃথিবীপতে। সৌভদ্রশ্চ মহাবাহুঃ শঙ্খান দধমুঃ পৃথক পৃথক।। ১৮।। অনুবাদঃ-- হে
মহারাজ, মহাধনুর্দ্ধর কাশীরাজ, মহারথ শিখণ্ডী, দৃষ্টদ্যুম্ন, রাজা বিরাট, অপরাজিত
সাত্যকি, রাজা দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র এবং মহাবীর অভিমন্যুও নিজ নিজ শঙ্খ
বাজালেন।
১৯)স ঘোষো
ধার্ত্তরাষ্ট্রাণাং হৃদয়ানি ব্যদারয়ৎ। নভশ্চ পৃথিবীঞ্চৈব তুমুলোহভ্যনুনাদয়ন।।
অনুবাদঃ-- সেই তুমুল শব্দ আকাশ ও পৃথিবীতে প্রতিধ্বনিত হয়ে ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ ও
তৎপক্ষীয়দিগের হৃদয় বিদীর্ণ করল।
২০) অথ
ব্যবস্থিতান দৃষ্টা ধার্ত্তরাষ্ট্রান কপিধ্বজঃ। প্রবৃত্তে শস্ত্রসম্পাতে
ধনুরুদ্যম্য পাণ্ডবঃ।। অনুবাদঃ-- হে মহারাজ, আপনার পক্ষের বীরদিগকে যুদ্ধের জন্য
প্রস্তুত দেখে শস্ত্র নিক্ষেপ আরম্ভ হওয়ার সময় কপিধ্বজ অর্জ্জুন ধনু তুলে
শ্রীকৃষ্ণকে এই কথা বললেন।
[ ২১ শ্লোক থেকে
শুরু হবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের কথাবার্তা। তার আগে আমরা দেখতে পাচ্ছি,
পাণ্ডবপক্ষের সকলেই মাঙ্গলিক শঙ্খধ্বনিতে বিশ্বাসী এবং পিতামহ ভীষ্মের পথ অনুসরণ
করে ধর্মযুদ্ধের জন্যই শঙ্খধ্বনি করলেন। কিন্তু রাজা দুর্যোধন শঙ্খধ্বনিকে
মঙ্গলসূচক বার্তা বলে বিশ্বাস করতেন না, তাই তিনি পিতামহ ভীষ্মের পথ অনুসরণ করলেন
না। বর্ত্তমানকালেও আমরা অহংকারী সনাতন ধর্মবিরোধী নেতাদের দেখি তাঁরা এই
শঙ্খধ্বনিকে সকলের মাঙ্গলিক ধ্বনি বলে বিশ্বাস করেন না। অধর্মের বিনাশ ও ধর্মের
প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে নিজ গৃহ- সমাজ- রাষ্ট্র কোথাও শান্তির প্রতিষ্ঠা হয় না।
এই বার্তায় পিতামহ ভীষ্ম যখন শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে জানালেন তখন তাঁর আহ্বানে সাড়া
দিয়ে প্রথম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, পরে মহাত্মা অর্জ্জুন তাঁদের দিব্য শঙ্খ বাজিয়ে তাঁকে
স্বীকৃতি দিলেন। জয় বেদভগবান শ্রীকৃষ্ণের জয়।]
No comments:
Post a Comment