[ পবিত্র গীতা
মহৎ, যা মহৎ তা চিত্তকে উদার করে, ব্যাপক করে। আর যা ভীষণ তা চিত্তকে ক্ষুদ্র করে,
সঙ্কুচিত করে। বিশ্বরূপ দর্শনে অর্জ্জুন যা দেখেছেন তা বিশাল ঈশ্বরের হৃদয়, যার
বিশালতায় শ্রোতা, পাঠক ও দর্শকের চিত্ত বিস্ফারিত, অন্তর উৎফুল্ল ও হর্ষযুক্ত
স্বাভাবিকভাবেই হয়ে উঠে। তাই অর্জ্জুন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলছেন—ঠাকুর, পরমেশ্বর,
পরমপিতা, তোমারই দেওয়া দৃষ্টিতে তোমাকেই দেখছি, দেখে কিন্তু ঠিকই চিনতে পারছি তুমি
কে। তোমার রূপ- ঐশ্বর্য তোমার স্বরূপের পরিচয় দিচ্ছে সুস্পষ্ট ভাবেই। তুমি যে
অক্ষর পরাৎপর ব্রহ্ম, তুমি যে নিখিল বিশ্বের পরম আশ্রয়, তুমি যে সনাতন পুরুষ,
সনাতন ধর্ম্মের চিররক্ষক, তা বুঝতে আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছে না। তুমি কত
বড়! হে মহাত্মা, পৃথিবী আর স্বর্গের মধ্যে অন্তরীক্ষে যতখানি জায়গা আর দশদিকে
যতখানি স্থান--- সবই ব্যাপিয়া রয়েছো তুমি তোমার বিপুল সত্তা দ্বারা। আগে মনে করতাম
এগুলি সব ফাঁকা জায়গা, শূন্য স্থান, এখন দেখতে পাচ্ছি তা নয়, সবই তোমাদ্বারা
পরিপূর্ণ। আজ আমরা সকলে মিলে শ্রীগীতার ২১ থেকে ৩০ শ্লোক বা মন্ত্র উচ্চারিত করবো
মহাত্মা অর্জ্জুনের সাথে সাথে বিশ্বরূপের উদ্দ্যেশে। ]
২১) ঐ দেখো,
সমস্ত দেবতা তোমাতে প্রবেশ করছেন—কেহ বা ভয়ে করজোড়ে তোমার প্রার্থনা করছে এবং “
স্বস্তি স্বস্তি” বলে মহর্ষি এবং সিদ্ধদিগের সকলে বহুবিধ স্ত্রোত্র দ্বারা তোমারই
স্বব করছে।
২২) রুদ্র, আদিত্য, বসু, সাধু ও বিশ্বদেবগণ অশ্বিনীকুমারদ্বয়, মরুৎ ও
পিতৃগণ, গন্ধর্ব্ব, যজ্ঞ, অসুর ও সিদ্ধগণ – সকলেই একান্ত বিস্ময় ভরে তোমার দিকে
তাকিয়ে আছেন।
২৩) হে মহাবাহু, অসংখ্য তোমার মুখ, অসংখ্য তোমার চোখ, হাত, উরু, পা, উদর ও
দন্ত—সবই তোমার অসংখ্য, তাই তোমার এই রূপ অতিশয় ভয়ংকর দেখাচ্ছে। এতে সবাই তোমাকে
ভয় পাচ্ছে এবং আমিও ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছি।
২৪) হে সর্ব্বব্যাপী দেবতা, হে বিষ্ণু, তোমার এই মুর্ত্তি সমস্ত আকাশ জুড়ে
ব্যাপ্ত। ইহা তেজোময়, নানাবর্ণ- বিশিষ্ট ও বিস্তৃত মুখব্যাদান এবং প্রদীপ্ত বিশাল
নেত্রযুক্ত। তোমার এই মুর্ত্তি দেখে আমি অত্যন্ত ভীত হয়েছি। কিছুতেই আমি ধৈর্য্য
ধরতে পারছি না বা শান্তি পাচ্ছি না।
২৫) হে দেবেশ, দীর্ঘ দন্ত দ্বারা বিকৃত প্রলয়াগ্নি সদৃশ তোমার বদনমণ্ডল
দেখে আমি দিশাহারা হয়ে পড়েছি। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না আমি। হে জগতের পরম আশ্রয়,
তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও।
২৬—২৭) রাজন্যবর্গসহ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ, এবং ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ ও
আমাদের বীরগণ তোমার এই দ্রষ্ট্রাংকরাল ভয়ঙ্কর দর্শন মুখগহ্বরের দিকে ধাবিত হয়ে
অতিশয় বেগে তাহাতে প্রবেশ করছে। কারো কারো মস্তক চূর্ণ –বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে ঐ করাল
দশনের নির্ম্মম দংশনে। কারো কারো বা চূর্ণিত মস্তক লেগে আছে ঐ দন্তগুলির ফাঁকে
ফাঁকে।
২৮) নদীসমূহের অজস্র জলপ্রবাহ যেমন সমুদ্রের দিকে ছুটতে ছুটতে সমুদ্রেই লীন
হয়, সেইরূপ মনুষ্যলোকের এই বীরগণও তোমার সর্ব্বতো ব্যাপ্ত মুখগহ্বরে প্রবেশ করছে।
২৯) পতঙ্গগুলি যেমন অতিবেগে ধাববান হয়ে মৃত্যুর কোলে আত্মবিসর্জ্জনের জন্য
অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করে, সেইরূপ এই লোকসকল মরণের নিমিত্তই অতিবেগে তোমার মুখগহ্বরে
প্রবেশ করছে।
৩০) তুমি জ্বলন্ত মুখগুলি দ্বারা এই সমস্ত লোককে গ্রাস করছো। তোমার
বিশ্বগ্রাসী মুখের মধ্যে বিশ্বজগৎ ঢুকছে। তোমার লেলিহান জিহ্বা দ্বারা তুমি
তাদেরকে পুনঃপুনঃ টেনে নিচ্ছ যেন স্বাদ গ্রহণ করছো। হে বিষ্ণু! তোমার তীব্র
তেজোরাশিতে তীব্র প্রভায় দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে সমস্ত জগৎ।
[ জয় বিশ্বমানব শিক্ষা ও ভগবান বিশ্বরূপের জয়। জয় বেদমাতা, বিশ্বমাতা ও
গীতামাতার জয়।]
No comments:
Post a Comment