[ গীতার পঞ্চম অধ্যায়ের সন্ন্যাসযোগঃ
অর্জ্জুনের এক প্রশ্নের উত্তরের মীমাংসা নিয়ে শুরু হয়েছে। ভগবানের উক্তির মধ্যে
একবার কর্ম্মত্যাগের আর একবার কর্ম্মযোগের সুর শ্রুত হয়েছে। তাই দুয়ের মধ্যে যেটি
শ্রেয়স্কর সেটি স্পষ্ট ভাষায় প্রশ্নকারী অর্জ্জুন শুনতে চাহেন ভগবানের মুখ থেকে।
অর্জুনের প্রশ্নের উত্তর এই অধ্যায় ভরে চলেছে। মোট শ্লোক ২৯ টি। প্রথম মন্ত্রে
অর্জ্জুনের প্রশ্ন। শেষ মন্ত্রে নূতন সংবাদ। মধ্যবর্ত্তী ২৭ টি মন্ত্রে নানাদিক
থেকে প্রশ্নের জবাব। আজকে সকলের পাঠের জন্য ১ থেকে ১২ মন্ত্র প্রদত্ত হচ্ছে, এর
মধ্যে ২ থেকে ১২ মন্ত্র কর্ম্মসন্ন্যাস প্রকরণ।]
১) অর্জ্জুন
বললেন, হে কৃষ্ণ, তুমি কর্ম্মত্যাগের কথাও বলছো আবার কর্ম্মযোগেরও প্রশংসা করছো।
এই দুয়ের মধ্যে যেটি শ্রেয়স্কর, সেটি আমাকে স্পষ্টভাবে বল।
২) শ্রীভগবান বললেন, সন্ন্যাস ও কর্ম্ম উভয়েই মোক্ষপ্রদ। কিন্তু এই দুইটির
মধ্যে কর্ম্মসন্ন্যাস অপেক্ষা কর্ম্মযোগ শ্রেষ্ঠ।
৩) হে মহাবাহু, যিনি দ্বেষ করেন না, কোন কিছু আকাঙ্ক্ষা করেন না তিনি
নিত্যসন্ন্যাসী বলে গণ্য। কারণ এইরূপ রাগদ্বেষাদিশূন্য শুদ্ধচিত্ত পুরুষ অনায়াসে
সংসারবন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করেন।
৪) অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিগণই সন্ন্যাস ও কর্ম্মযোগকে পৃথক বলে গণ্য করেন।
কিন্তু পণ্ডিতগণ এরূপ করেন না কারণ ইহার একটি সম্যক অনুষ্ঠিত হলেই উভয়ের ফল লাভ
হয়।
৫) সাংখ্যগণ যে স্থান লাভ করেন কর্ম্মযোগীগণও সেই স্থান লাভ করেন। সন্ন্যাস
ও কর্ম্মযোগকে যিনি একরূপ দেখেন তিনিই যথার্থদর্শী।
৬) হে মহাবাহু, কর্ম্মযোগ বিনা সন্ন্যাস কেবল দুঃখের কারণ হয়। কিন্তু
কর্ম্মযোগনিষ্ঠ সাধক অচিরেই ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার লাভ করেন।
৭) বিশুদ্ধাত্মা, বিজিতচিত্ত, জিতেন্দ্রিয়, যিনি সর্ব্ব প্রাণীর সহিত
একাত্মতা বোধ করেন এমন পুরুষ, যোগযুক্ত হয়ে কর্ম্ম করলেও কর্ম্মে আবদ্ধ হন না।
৮—৯) নিষ্কাম কর্ম্মযোগী ক্রমে তত্ত্বদর্শী হয়ে দর্শনে, শ্রবণে, স্পর্শনে,
আঘ্রাণে, ভোজনে গমনে, নিদ্রায়, নিঃশ্বাস গ্রহণে, বাক্যলাপে, মলমূত্রাদি ত্যাগে,
গ্রহণে, চক্ষুর উন্মেষে এবং নিমেষেও ইন্দ্রিয়গণই স্ব স্ব বিষয়ে প্রবৃত্ত এরূপ দৃঢ়
ধারণা করেন, ‘ আমি কিছুই করি না’ – ইহা মনে করেন।
১০) যিনি কর্ম্মফলে আসক্তিত্যাগ পুর্ব্বক পরমেশ্বরের উদ্দ্যেশে সকল কর্ম্ম
করেন, জল যেমন পদ্মপত্রকে সিক্ত করতে পারে না, পাপপুণ্য সেইরূপ তাঁকে স্পর্শ করে
না।
১১) কর্ম্মযোগীগণ ফল কামনা ও কর্ত্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করে চিত্তশুদ্ধির
নিমিত্ত কেবল শরীর, মন, বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়াদি দ্বারা কর্ম্ম করেন।
১২) নিষ্কাম কর্ম্মযোগীগণ কর্ম্মফল ত্যাগ করে ব্রহ্মনিষ্ঠা হতে উৎপন্ন পরম
শান্তি লাভ করেন। সকাম ব্যক্তিগণ কামনাজনিত কার্য্য করার দরুণ আসক্তি- বশতঃ আবদ্ধ
হন। ।। জয় বেদভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীশ্রীগীতার জয়।।
[ ধ্যান বা মনন দ্বারা মানুষ অসাধ্য সাধন করতে
সক্ষম। গীতার ধ্যান করতে করতে মানুষের মন- প্রাণ- বুদ্ধি- আত্মা গীতাময় হয়ে যায়।
তখন মানুষের অন্তরে জীবসত্তার যে ভাব, সেই
ভাব থাকে না, কারণ জীবের বুদ্ধি গীতা গ্রাস করে নেন এবং নিজের বুদ্ধির সাথে
জীবসত্তাকে যুক্ত করে নেন। এই বুদ্ধি বা জ্ঞানই হচ্ছে মানুষের প্রকৃত সন্ন্যাস।]
No comments:
Post a Comment