[ শ্রীগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে
বলেছেন, দ্রব্যময় যজ্ঞ থেকে জ্ঞান যজ্ঞ( বেদযজ্ঞ) শ্রেয়ঃ। কেননা, মোক্ষদায়ক
জ্ঞানের বিকাশে সমস্ত কর্ম্ম শেষ হয়ে যায়।]( ২০ থেকে ৪২ পর্যন্ত শ্লোকের বাংলা
অনুবাদ)। চতুর্থ অধ্যায়ের প্রধান লক্ষ্য, কর্ম্ম ও জ্ঞানভূমির একত্ব সাধন। বেদযজ্ঞ
করেই মানুষকে সত্যভূমিতে বিচরণ করতে হয় এবং কর্ম্মফলের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে হয়।
দেহীর আশ্রয় দেহ। যার দেহেতে আত্মজ্ঞান সে দেহাশ্রয়ী, যার দেহেতে আত্মজ্ঞান নাই সে
নিরাশ্রয়। কর্ত্তৃত্বাভিমান ব্যক্তি নিরাশ্রয়। তাই যিনি নিত্যতৃপ্ত ও নিরাশ্রয়
তিনি কর্ম্মের অনুষ্ঠান করলেও কিছুই করেন না—তিনিই মুক্ত পুরুষ। আজকের জ্ঞানযোগঃ
সকলের জন্য ২০ থেকে ৪২ শ্লোক--- সকলে মনোযোগ সহকারে পাঠ করুন ও নিজের শক্তিতে জেগে
উঠুন ধর্মযুদ্ধ করার জন্য। জয় বেদভগবান শ্রীকৃষ্ণের জয়।
২০) যিনি কর্ম্মে
ও কর্ম্মফলে আসক্তি পরিত্যাগ করেছেন, যিনি আপনাতেই সর্বদা পরিতৃপ্ত, যিনি কোন
প্রয়োজনে অপরের আশ্রয় গ্রহণ করেন না।, তিনি কর্ম্মে প্রবৃত্ত হলেও প্রকৃতপক্ষে
কিছুই করেন না।
২১) যিনি
নিষ্কাম, যার চিত্ত ও ইন্দ্রিয় সংযত, যিনি দান- উপহারাদি সর্বপ্রকার উপঢৌকন গ্রহণ
থেকে বিরত, তিনি কেবল শরীর দ্বারা কর্ম্ম করেন এবং কোন প্রকার পাপভাগী হন না।
২২) যিনি বিনা
চেষ্টায় যা পান তাতেই সুখী, যিনি সুখদুঃখাদিতে অবিচল, যিনি পরশ্রীকাতর নহেন,
সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে যার সমজ্ঞান তিনি কর্ম্ম করেও কর্ম্মতে লিপ্ত হন না।
২৩) যিনি
আসক্তিশূন্য, রাগদ্বেষাদিমুক্ত, জ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্মে স্থিত, তিনি যজ্ঞার্থ কর্ম
করেন এবং তাঁর সমগ্র কর্ম্ম ফলসহ বিনষ্ট হয়, উহা বন্ধনের কারণ হয় না।
২৪) হোমাগ্নিতে
দ্রব্যের অর্পণকে, ঘৃতকে, হোমের অগ্নিকে, আহুতি দানের কর্ত্তাকে, এবং হোমক্রিয়াকে
যিনি ব্রহ্ম বলে জ্ঞান করেন, ব্রহ্মকর্মে সমাহিতচিত্ত সেই ব্যক্তি ব্রহ্মকেই
প্রাপ্ত হন।
২৫) অন্য যোগীরা
দৈব যজ্ঞের উপাসনা করেন কিন্তু জ্ঞানযোগীগণ ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে কর্ম্মাহুতি দিয়ে
থাকেন।
২৬) কোন কোন যোগী
সংযম রূপ অগ্নিতে চক্ষু কর্ণাদি ইন্দিয় সকলকে আহুতি দেন, অন্য কেউ ইন্দিয়রূপ
অগ্নিতে শব্দাদি বিষয় সকল আহুতি দেন।
২৭) অপর কেহ
জ্ঞান দ্বারা উদবোধিত আত্মসংযমরূপ অগ্নিতে সর্ব ইন্দিয়- কর্ম ও প্রাণ –কর্ম আহুতি
দেন—অর্থাৎ সমস্ত শরীর ব্যাপার সংযত করাই তাঁর যজ্ঞ।
২৮) কেউ
দ্রব্যযজ্ঞ করেন, কেউ তপস্যাযজ্ঞ করেন, আবার কেউ বা প্রাণায়ামাদি যোগযজ্ঞ করেন।
আবার কোন কোন দৃঢ়ব্রত যতি শাস্ত্রার্থজ্ঞানলাভরূপ যজ্ঞও করেন।
২৯) কেউ
বা অপান বায়ুতে প্রাণ-বায়ু আহুতি দেন(পূরক), কেউ বা প্রাণ বায়ুতে অপান বায়ু আহুতি
দেন(রেচক)। আবার কেউ বা প্রাণ ও অপানের গতিরুদ্ধ করে (কুম্ভক) প্রাণায়াম- পরায়ণ
হন।
৩০) অপর কেউ আহার সংযম করে প্রাণবায়ু সমূহে অন্যান্য প্রাণবায়ু আহুতি দেন।
এই সকল যজ্ঞবিদ, সকলেই যজ্ঞ দ্বারা পাপমুক্ত হন।
৩১) এই যজ্ঞবিদগণ যজ্ঞাবশিষ্টরূপ অমৃত ভোজন করে সনাতন ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন।
হে কুরুসত্তম, যে যজ্ঞকর্মে নিয়োজিত নয়, তার ইহলোক পর্যন্ত নেই, পরলোক তো দূরের
কথা।
৩২) এই প্রকার বহুবিধ যজ্ঞের কথা ব্রহ্মার মুখে বেদে বিস্তারিত ভাবে বলা
হয়েছে। এই সকল যজ্ঞ কিন্তু কর্ম্মমূলক। এ তত্ত্ব জানতে পারলেও তুমি মুক্তি পাবে।
৩৩) হে মহাবীর অর্জুন, দ্রব্যময় যজ্ঞ থেকে জ্ঞান যজ্ঞ শ্রেয়ঃ। কেননা,
মোক্ষদায়ক জ্ঞানের বিকাশে সমস্ত কর্ম শেষ হয়ে যায়।
৩৪) শ্রীগুরুচরণে প্রণাম দ্বারা, তত্ত্ব- বিষয়ক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা দ্বারা ও
গুরুসেবা দ্বারা সেই জ্ঞান লাভ কর। শাস্ত্রজ্ঞ ও অনুভবসিদ্ধ পণ্ডিতগণ তোমাকে সেই
জ্ঞান সম্পর্কিত উপদেশ দান করবেন।
৩৫) হে অর্জুন, এই জ্ঞান লাভ করলে তোমার আর মোহ থাকবে না। ইহা দ্বারা সমস্ত
প্রাণীকে স্বীয় আত্মাতে এবং অনন্তর আমাতে, দেখতে পাবে।
৩৬) তুমি যদি সমুদয় পাপী হতেও অধিকতর পাপাচারী হও, তথাপি জ্ঞানরূপ তরণী
দ্বারা সমস্ত পাপসমুদ্র উত্তীর্ণ হতে পারবে।
৩৭) হে অর্জুন, জ্বলন্ত অগ্নি যেমন সকল কাষ্ঠকেই ভস্মসাৎ করে, সেইরূপ
জ্ঞানরূপ অগ্নি সমস্ত কর্মকে ভস্মীভূত করে।
৩৮) ইহলোকে জ্ঞানের মত পবিত্র অন্য কোন বস্তু নেই। এই জন্য জ্ঞানযুক্ত যোগী
যথাকালে পরমাত্মায় লয়প্রাপ্ত হন।
৩৯) যিনি সাধু- গুরু- শাস্ত্রবাক্যে শ্রদ্ধাবান, সাধনে একনিষ্ঠ ও
জিতেন্দ্রিয়, তিনি আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারেন। এই জ্ঞান লাভ করে তিনি শীঘ্রই পরম
শান্তি লাভ করেন।
৪০) অজ্ঞ, শ্রদ্ধাহীন ও সংশয়ী চিত্ত ব্যক্তি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। যে ব্যক্তি
শাস্ত্র বা গুরুর উপদেশে সন্দেহ পোষণ করে তার ইহলোক নাই, পরলোক নাই এমন কি, বৈষয়িক
সুখও নাই।
৪১) হে অর্জুন, যোগ দ্বারা যিনি সর্বকর্ম শ্রীভগবানে সমর্পণ করেছেন,
আত্মদর্শন রূপ জ্ঞানের দ্বারা যার সকল সংশয় ছিন্ন হয়েছে সেই প্রমাদশূন্য আত্মবিদ
পুরুষকে কর্ম সকল আবদ্ধ করতে পারে না।
৪২) অতএব হে অর্জুন, তোমার হৃদয়ের অজ্ঞতাজাত এই সংশয়রাশিকে জ্ঞানরূপ খড়গ
দ্বারা ছেদন করে নিষ্কাম কর্মযোগ অবলম্বন কর এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। ইতি
জ্ঞানযোগ নামক চতুর্থ অধ্যায়।
No comments:
Post a Comment