বিশ্বমানব শিক্ষায় পবিত্র কুরআনের আলো। [
সুরা-২, আল- বাকারা ৮৩ থেকে ৯৩ আয়াত]
৮৩)
স্মরণ কর ( সেই সময়ের কথা) যখন বনী ইসরাঈলের কাছ থেকে আমি অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে,
তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করবে না, মাতা-পিতা, আত্মীয়- স্বজন, এতিম ও
দরিদ্রের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে এবং মানুষের সাথে সদালাপ করবে, যথাযথভাবে নামায
প্রতিষ্ঠিত করবে এবং যাকাত প্রদান করবে। কিন্তু স্বপ্ল সংখ্যক লোক ব্যতীত তোমরা
সকলে( এ প্রতিজ্ঞা পালনে) বিমুখ হয়ে গেলে।
৮৩ নং আয়াত পাঠ করে স্পষ্টভাবে জানা যাচ্ছে যে
আল্লাহ্ হচ্ছেন মানুষের অন্তরের আত্মার জ্ঞান- শক্তি- সত্য-প্রেম- বিশ্বাসের এক
প্রাচীন সূত্র বা বলয়। এই সূত্র বা বলয়ের সাথে মানুষ যুক্ত থাকতে পারে তাঁকে
দৃঢ়ভাবে পূজার আসনে বসিয়ে, নিজেকে শ্রদ্ধাশীল ও প্রেমময় করে। এই আত্মাই হচ্ছেন
সকলের আল্লাহ্, তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে পূজা বা ইবাদত করতে নিষেধ করা হয়েছে।
তারপরে পরেই বলা হয়েছে মাতা- পিতা, আত্মীয়- স্বজন, এতিম ও দরিদ্রের প্রতি
সদ্ব্যবহার করতে এবং মানুষের সাথে সদালাপ করতে। এর কারণ এরা সকলেই আত্মার প্রাচীন
বন্ধু এবং অন্তরের আল্লাহ্স্বরূপ জ্ঞান ও শক্তির সাথে যুক্ত। তাদেরকে বাদ দিয়ে
আল্লাহ্র ইবাদতে কোন ফল হয় না। তারপরে বলা হলো, যথাযথভাবে নামায প্রতিষ্ঠিত করতে
এবং যাকাত দিতে। নামায এর অর্থ এখানে পবিত্র জ্ঞানকে অন্তরে প্রতিষ্ঠিত করা। আর
যাকাত দেওয়ার অর্থ নিজে জ্ঞানী হয়ে সেই জ্ঞান দান করা। কিন্তু দেখা গেল- এই সত্য
খুব অল্প সংখ্যক লোক মেনে চললো, বেশীরভাগ লোক যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে গেল।
তাহলে এখানে স্পষ্ট যে আল্লাহ্ ও সত্য বিমুখ জাতি হয়ে রয়েছে বিশ্বজুড়ে এক বিশাল
মানব সমাজ, অথচ তারাই কুরআন নিয়ে গর্ব করে।
৮৪) (হে
ইহুদী সমাজ! তোমরা নিজেদের অবস্থা স্মরণ কর) যখন আমরা তোমাদের নিকট থেকে ( এ মর্মে)
অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, তোমরা কেউ কারও রক্ত প্রবাহিত করবে না ও নিজেদের লোকজনকে
স্বদেশ হতে বহিষ্কার করবে না। অতঃপর তোমরা ত্রুটি স্বীকার করেছিলে, আর ( এ বিষয়ে)
তোমরাই তার সাক্ষী।
কুরআন
অবতীর্ণ হবার পূর্বে ইহুদী সমাজ যেভাবে মানুষের রক্ত প্রবাহিত করতো একইভাবে ইসলাম
প্রতিষ্ঠাকালের সময় হতেই এই রক্তের বন্যা বয়ে চলেছে বিশ্বজুড়ে।মুসলিম সমাজে
পার্থিব জগতের সহায় –সম্পদের গুরুত্ব বেশী, এই সম্পদের জন্য তারা নিজের আত্মীয়-
স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, এমনকি পিতা- মাতাকেও খুন করছে ও ঘর থেকে বহিষ্কার করছে। এর
কারণ মুসলমান জাতি আল্লাহ্র জগতে স্থির থাকতে সক্ষম হয় নি অঙ্গীকার অনুসারে।
তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোক কুরআনের আয়াতকে মান্যতা দিয়ে নামায প্রতিষ্ঠা করতে
ও যাকাত দিতে সক্ষম হয়েছে।
৮৫) তারপর (সেই তোমরাই তো) একে অন্যকে হত্যা করছ
এবং তোমাদের এক দলকে (তাদের) আপন গৃহ হতে বহিষ্কার করে দিচ্ছ, তোমরা তাদের
বিরুদ্ধে অন্যায় ও সীমালঙ্ঘন দ্বারা পরস্পরের পৃষ্ঠপোষকতা করছ এবং তারা যখন
বন্দীরূপে তোমাদের কাছে উপস্থিত হয় তখন তোমরা মুক্তিপণ চাও, অথচ তাদের বহিষ্করণই
ছিল তোমাদের জন্য অবৈধ। তবে কি তোমরা ধর্ম পুস্তকের কিছু অংশ বিশ্বাস কর, আর কিছু
অংশ অবিশ্বাস কর? অতএব তোমাদের (মধ্যে) যে সব লোক এমন কাজ করে, তাদের একমাত্র
প্রতিদান পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনাভোগ এবং কিয়ামতের দিন( শেষ বিচারের দিন) তারা
কঠিনতম শাস্তিতে নিক্ষিপ্ত হবে। তারা যা করে আল্লাহ্ সে সম্বন্ধে অনবহিত নন।
৮৫ নং আয়াত ইহুদী জাতির জন্য অবতীর্ণ হলেও
মুসলিম জাতির ভবিষ্যৎ বাণী উচ্চারিত হয়েছিল। সারা বিশ্বজুড়ে এই আয়াত অনুসারে
মুসলমানদের যে চরিত্র গড়ে উঠেছে তা মানব জাতি দেখতে পাচ্ছে। তাই তারা সকলেই
আল্লাহ্ বিমুখ ও কুরআন বিমুখ হয়ে সত্য প্রত্যাখ্যানকারী জাতিতে পরিণত হয়েছে। তাই
তাঁদের আর মুসলমান জাতি, ঈমানদার ব্যক্তি, ইসলাম ধর্ম নিয়ে গর্ব করা চলে না। তাঁরা
সত্য বিমুখ ও সীমালঙ্ঘনকারী জাতিতে পরিণত হয়েছে তাঁদের আল্লাহ্র কাছে।
৮৬) তারাই পরকালের বিনিময়ে পার্থিব জীবন ক্রয়
করে, সুতরাং তাদের শাস্তি লাঘব করা হবে না এবং তারা কোন সাহায্যও পাবে না।
মুসলিম জাতি পরকালকে ভয় করে না, তারা
অন্যায়কারী জাতিতে পরিণত হয়েছে পার্থিব জীবন ক্রয় করতে গিয়ে, সুতরাং তাদের শাস্তি
আল্লাহ্ লাঘব করবেন না এবং তারা আল্লাহ্র নিকট থেকে কোন সাহায্যও পাবে না, এই
আয়াতে তা স্পষ্ট করা হয়েছে।
৮৭) এবং নিশ্চয় মূসাকে কিতাব (তাওরাত গ্রন্থ)
দিয়েছি এবং তার পরে পর্যায়ক্রমে রসূলগণকে প্রেরণ করেছি, মারইয়াম পুত্র ঈসাকে
স্পষ্ট প্রমাণ দিয়েছি এবং পবিত্র আত্মা ( জিবরাঈল ফিরিশতা) দ্বারা তার শক্তি
বৃদ্ধি করেছি। তবে কি যখনই কোন রসূল এমন কিছু এনেছে যা তোমাদের মনঃপুত নয়, তখনই
তোমরা অহংকার করেছ এবং কতককে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছ এবং কতককে হত্যা করেছ?
এই আয়াতে আল্লাহ্ সমস্ত আগের ও পরের শাস্ত্র
গ্রন্থকে স্বীকৃত দিয়েছেন। যাদের মাধ্যমে এই গ্রন্থ অবতীর্ণ হয় তিনি তাঁদের অন্তরে
পবিত্র আত্মাকে যুক্ত করে দেন এবং তাঁদের অন্তরে জ্ঞান- প্রেম- সত্য- বিশ্বাসের
শক্তি বৃদ্ধি করেন।কিন্তু মানুষ সাম্প্রদায়িক মন নিয়ে তাঁর বিরোধিতা করেন, তাঁকে মিথ্যাবাদী সাজাবার সবরকম
প্রচেষ্টা চালান। অনেককে আবার হত্যা করেন। এখানে মূসা, ঈশাকে কেবল তিনি স্বীকৃতি
দেন নি সকল নবীকে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং তাঁদের সকলের অন্তর পবিত্র আত্মার
সাথে যুক্ত করেছেন, সেই কথায় ব্যক্ত করেছেন।
৮৮) তারা বলেছিল, আমাদের হৃদয় আচ্ছাদিত। বরং
সত্য প্রত্যাখ্যানের জন্য আল্লাহ্ তা’য়ালা তাদের অভিশাপ দিয়েছেন, সুতরাং তাদের
অল্প সংখ্যকই বিশ্বাস করে।
এই আয়াত পাঠ করলেই মুসলিম জাতি বুঝতে পারবেন,
তাঁদের অন্তরের কথায় এখানে ব্যক্ত হয়েছে। তাঁদের হৃদয় আচ্ছাদিত, তাঁরা সত্য
প্রত্যাখ্যান করবে এবং তাঁরা বিশ্বে আল্লাহ্ তা’য়ালার অভিশপ্ত জাতিতে পরিণত হবে। কারণ খুব অল্প সংখ্যক
ব্যক্তিই পবিত্র কুরআনের সত্যকে অন্তরে ধারণ করে আছেন।
৮৯) তাদের নিকট যা আছে আল্লাহ্র নিকট হতে তার
সমর্থক কিতাব এল, যদিও পূর্বে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে তারা এর সাহায্যে বিজয়
প্রার্থনা করত, তবুও তারা জ্ঞাত ছিল সেটা যখন তাদের নিকট এল তখন তারা তা
প্রত্যাখ্যান করল। সুতরাং অবিশ্বাসীদের প্রতি আল্লাহ্র অভিসম্পাত।
এই
আয়াতে আল্লাহ্ অতীতে যা ছিল তাকেই সমর্থন
করেছেন, নূতন করে কিছুই তিনি বলেননি বা অবতীর্ণ করেননি। তাই যারা সত্যকে
প্রত্যাখ্যান করে সত্যবিমুখ হয়ে থাকেন তাঁরাই অবিশ্বাসী আর এই অবিশ্বাসী জাতির
বিরুদ্ধে নেমে আসে অভিসম্পাত।
৯০) সেটা কত নিকৃষ্ট যার বিনিময়ে তারা আত্মাকে
বিক্রয় করেছে- তা এই যে, আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন ঈর্ষান্বিত হয়ে তারা তা
প্রত্যাখ্যান করত শুধু এ কারণে যে, আল্লাহ্ তার বান্দাদের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা
অনুগ্রহ করেন। সুতরাং তারা ক্রোধের উপর ক্রোধের পাত্র হল। অবিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে
লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।
এই
আয়াতে বলা হয়েছে অবিশ্বাসী লোকদের নিজ আত্মার প্রতি বিশ্বাস নেই, তাই তারা
পরশ্রীকাতর হয়ে আত্মজ্ঞান বিক্রি করে কাম- ক্রোধ- লোভ- মোহ- মদ ও মাৎসর্যের অধীনে
কাজ করে, তারা আত্মার বা আল্লাহ্র দাসত্ব না করে হিংসা- দ্বেষের দাসত্ব করতে
থাকে। তাই এদের অন্তর থেকে পবিত্র আত্মার শক্তি চলে যায় এবং তারা অবিশ্বাসী
বিশ্বাসঘাতকে পরিণত হয়ে অভিশপ্ত আত্মাতে পরিণত হয়। এই অভিশপ্ত আত্মা আল্লাহ্
কাউকে দান করলেও সেই দানকে অবিশ্বাস করে ও হিংসা করে। তাই এরা আল্লাহ্র ক্রোধের
উপর ক্রোধের পাত্র হয়ে থাকে।
৯১) এবং যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ যা অবতীর্ণ
করেছেন তাতে বিশ্বাস কর, তারা বলে, আমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে আমরা তাতে
বিশ্বাস করি। অথচ সব কিছুই তারা প্রত্যাখ্যান করে, যদিও তাহা সত্য এবং তাদের নিকট
যা আছে তার সমর্থক। বল, যদি তোমরা বিশ্বাসী হতে তবে কেন তোমরা অতীতে নবীগণকে হত্যা
করেছিলে?
কুরআনের পূর্বে বহু আলোদানকারী গ্রন্থ অবতীর্ণ
হয়েছে মানুষের আত্মাকে পবিত্র করার জন্যে। কিন্তু সেসব গ্রন্থকে মান্যতা দিয়ে কজন
মানুষ নিজ আত্মাকে পবিত্র করে তোলে? তারা নিজের জাতি- সম্প্রদায়- ধর্ম নিয়ে অহংকার
করলেও কেউ সত্যকে নিজ অন্তরে প্রতিষ্ঠিত করে না, সেই সত্যের সমর্থক হয়ে। সত্যকে
জানলে কেউ একে অপরের প্রতি বিশ্বাস হারাতে পারে না। কেউ কাউকে হত্যা করতেও পারে
না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে মানুষ সত্য প্রতিষ্ঠাকারী নবীগণকেও হত্যা করেছে, নিজেদের
স্বার্থে।
৯২) এবং (হে বনী ইসরাঈলগণ!) নিশ্চয় মূসা তোমাদের
নিকট স্পষ্ট প্রমাণসহ এসেছিল, ( কিন্তু তা সত্ত্বেও তার অনুপস্থিতে) তোমরা
সীমালংঘনকারী হয়ে বাছুরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছিলে।
এই আয়াতে বলা হয়েছে এই পৃথিবী গাভী স্বরূপ। আর
তাঁর সম্পদ বাছুর স্বরূপ। মূসা সত্য- জ্ঞান- বিশ্বাস- প্রেমের সম্পদ নিয়ে সকলের আত্মাকে
উজ্জ্বল করে রাখতেন। তাঁর অনুপস্থিতে মানবজাতি পুনঃ বাছুরের অর্থাৎ পার্থিব
সম্পদের পূজা শুরু করে অবিশ্বাসী জাতিতে পরিণত হয়। পার্থিব জগতের সম্পদের মোহে
আবদ্ধ হলেই মানুষ সত্যজ্ঞান হারিয়ে দুর্বল জাতিতে পরিণত হয়।
৯৩) আরও স্মরণ কর (সে সময়ের কথা) যখন তোমাদের
অঙ্গীকার নিয়েছিলাম, এবং তূরকে তোমাদের ঊর্ধ্বে স্থাপন করেছিলাম, (বলেছিলাম) যা
দিলাম দৃঢ়রূপে গ্রহণ কর এবং শ্রবণ কর। তারা বলেছিল, আমরা শ্রবণ করলাম ও অমান্য
করলাম। অবিশ্বাস হেতু তাদের হৃদয়ে বাছুরপ্রীতি সিঞ্চিত হয়েছিল। বল, যদি তোমরা
বিশ্বাসী হও তবে তোমাদের বিশ্বাস যার নির্দেশ দেয় তা কত নিকৃষ্ট।
এখানে
মানুষের স্থান পর্বতের চূড়ারও ঊর্ধ্বে, সেটা তিনি পর্বতকে মানুষের ঊর্ধ্বে স্থাপন
করে দেখিয়ে তার প্রমাণ দিয়েই সত্য আয়াত অবতীর্ণ করেন। কিন্তু মানুষ সত্য শুনে
কিন্তু সত্যকে মান্যতা দিয়ে জীবন গড়ে তুলে দেহাতীত- ত্রিগুণাতীত- ত্রিকালাতীত হয়ে
তূর পর্বতের ঊর্ধ্বে নিজেকে স্থাপন করার সাধনা করে না। তাদের বিশ্বাস বাছুর প্রীতির
প্রতি অর্থাৎ পার্থিব জীবন ও পার্থিব সম্পদের প্রতি। এই বিশ্বাস কত নিকৃষ্ট, এই
চিন্তা কি মানুষকে অবিশ্বাসী করে আল্লাহ্ ও সত্য বিমুখ করে তুলছে না? জয়
বিশ্বমানব শিক্ষার জয়। জয় পবিত্র কুরআনের আলোর জয়।
No comments:
Post a Comment