[ গীতার পঞ্চদশ
অধ্যায়ের পুরুষোত্তমযোগঃ- এ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজ মুখে পুরুষোত্তম তত্ত্বটি বলেছেন।
এটিই এই অধ্যায়ের বিশেষত্ব। তিনি পরিণামী এই বিশ্বজগৎকে একটি অশ্বত্থ বৃক্ষের
সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রাকৃত জগতের বৃক্ষের মূল নীচে, শাখা ঊর্দ্ধে। এই
সংসারবৃক্ষের কিন্তু মূল ঊর্দ্ধে পুরুষোত্তমে। আর শাখা- প্রশাখা নিম্নগামী।
অশ্বত্থবৃক্ষের যেমন ঝুরি বা অবান্তর মূল সেগুলি নিম্নদিকে বিস্তৃত হয়ে মাটি কামড়ে
ধরে, তেমনি এই সংসারবৃক্ষের কতকগুলি কৃত্রিম মূল আছে। আসল মূল হল ঊর্দ্ধে
পুরুষোত্তমে আর কৃত্রিম মূলগুলি হল নিম্নদিকে জীবের কামনা- বাসনা স্বরূপ। কামনা-
বাসনা দ্বারাই জীব ধর্ম্মাধর্ম্মে প্রবৃত্ত হয়। আজকে আমরা গীতার পুরুষোত্তমযোগঃ
অধ্যায়ের ১ থেকে ১০ মন্ত্র শুনবো স্বয়ং পুরুষোত্তম শ্রীভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে
অন্তরের শ্রদ্ধা- ভক্তি নিয়ে।]
১) শ্রীভগবান
বললেন—পণ্ডিতগণ এই সংসারকে অশ্বত্থ বৃক্ষ বলে অভিহিত করেছেন। ইহার মূল ঊর্দ্ধে,
শাখা নিম্নদিকে। ক্ষণস্থায়ী অশ্বত্থ হলেও ইহার অবস্থান অনাদি ও নিত্য।
কর্ম্মজ্ঞানাত্মক বেদমন্ত্রগুলি ইহার পত্র। যিনি এই সংসারবৃক্ষের স্বরূপ জানেন,
তিনিই বেদজ্ঞ।
২) সেই বৃক্ষের
শাখাসমূহ গুণত্রয় দ্বারা বর্ধিত ও বিষয়রূপ পত্রপল্লব বিশিষ্ট। ইহা অধোদেশে ও
ঊর্ধ্বদেশে বিস্তৃত। মনুষ্যলোকে ইহার ধর্ম্মাধর্ম্মজনক কর্ম্মের মূলসমূহ নিম্নদিকে
বিস্তৃত হয়ে আছে।
৩—৪) ইহলোকে
সংসারবৃক্ষের স্বরূপ বোঝা যায় না। ইহার আরম্ভ নাই, মধ্য বা স্থিতি নাই এবং ইহার
অন্তও নাই। এই দৃঢ়মূল সংসারবৃক্ষকে প্রগাঢ় বৈরাগ্যরূপ শাণিত অস্ত্র দ্বারা ছেদন
করে, যাকে পেলে পর সংসারে আর পুনরাগমন করতে হয় না, সেই পরম পদের অন্বেষণ করতে হয়।
যা থেকে এই সংসার জন্মেছে ও বিস্তৃতি লাভ করেছে, আমি সেই আদি পুরুষের শরণ নিলাম—এইভাবে
সেই পরম পদের অনুসন্ধান করতে হয়।
৫) যাদের অভিমান
ও মোহ বিদূরিত হয়েছে, যারা সংসারের আসক্তিরূপ দোষ জয় করেছেন, যারা আত্মতত্ত্বে
নিষ্ঠাবান, যাদের কামনা নিবৃত্ত হয়েছে, যারা সুখদুঃখরূপ দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত,
এইরূপ বিবেকী সাধু পুরুষগণ সেই পরম পদ লাভ করেন।
৬) যে পদ লাভ
করলে সাধক আর সংসারে প্রবেশ করেন না, চন্দ্র, সূর্য্য বা অগ্নি যাকে প্রকাশ করতে
পারে না, তা-ই আমার পরম স্বরূপ।
৭) আমারই সনাতন
অংশ জীবাত্মা প্রকৃতিতে অবস্থিত মন ও পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে এই কর্ম্মভূমি সংসারে আকর্ষণ
করে।
৮) বায়ু যেমন
পুষ্প থেকে গন্ধবিশিষ্ট সূক্ষ্ম কণাসমূহ নিয়ে যায়, সেইরূপ জীবাত্মা যখন এক দেহ
ছেড়ে অন্য দেহে প্রবেশ করে তখন সেই সকল ইন্দ্রিয়কে সঙ্গে করে নিয়ে যায়।
৯) দেহের অধীশ্বর
জীবাত্মা কর্ণ, চক্ষু, ত্বক, নাসিকা ও মনকে আশ্রয় করে শব্দাদি বিষয়সকল ভোগ করে
থাকে।
১০) জীবাত্মা
কিরূপে সত্ত্বাদি গুণসংযুক্ত হয়ে দেহে অবস্থিত থেকে বিষয়সমূহ ভোগ করে অথবা একদেহ
ছেড়ে অন্য দেহে আশ্রয় লাভ করে, তা অজ্ঞ ব্যক্তিগণ বুঝতে পারে না কিন্তু জ্ঞানীগণ
জ্ঞাননেত্রে তা দেখতে পান।
[ জয় বেদভগবান
পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের গীতার জয়।]
No comments:
Post a Comment